রোসেটা প্রস্তরফলক
প্রাচীন মিশরীয় প্রস্তরফলক / From Wikipedia, the free encyclopedia
রোসেটা প্রস্তরফলক হচ্ছে গ্র্যানোডাইয়োরাইট পাথরে খোদাইকৃত একটি ফলক। বাংলায় এটি রোসেটা স্টোন, রোসেটা পাথর, রোসেটা ফলক, ইত্যাদি নামে পরিচিত। ১৭৯৯ সালে আবিষ্কৃত এই প্রস্তরফলকটি মূলত একটি রাজকীয় ফরমান বা ডিক্রি যা প্রাচীন মিশরের টলেমীয় রাজবংশের রাজা পঞ্চম টলেমি পিফেনিসের পক্ষে তৎকালীন মিশরের মেম্ফিস নগরে ১৯৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জারি করা হয়। জারিকৃত ফরমানটি ফলকটির ওপরে তিনটি ভিন্ন সংস্করণে শিলালিপি হিসেবে খোদাই করা হয়েছিলো যার ওপরের ও মাঝের সংস্করণ দুইটি যথাক্রমে প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপি হায়ারোগ্লিফ ও ডেমোটিক লিপিতে, এবং নিচের অংশটি প্রাচীন গ্রিক ভাষায় খোদাইকৃত। ফরমানটি তিনটি ভিন্ন সংস্করণে লিখিত হলেও সংস্করণগুলোর মধ্যে অর্থগত পার্থক্য ছিলো খুব-ই সামান্য যার কারণে পরবর্তীতে প্রাচীন মিশরীয় লিপির পাঠোদ্ধারে এটি মূল চাবিকাঠির ভূমিকা পালন করে। সেই সাথে গত কয়েক শত বছর ধরে অজানা থাকার পর শেষ পর্যন্ত হায়ারোগ্লিফের পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে প্রাচীন মিশরের ইতিহাস সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা হয়।
রোসেটা প্রস্তরফলক | |
---|---|
উপাদান | গ্র্যানোডাইয়োরাইট |
আকার | ১,১২৩ মিমি × ৭৫৭ মিমি × ২৮৪ মিমি (৪৫ ইঞ্চি × ২৮.৫ ইঞ্চি × ১১ ইঞ্চি) |
লিখন | প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ, ডেমোটিক লিপি, এবং গ্রিক লিপি |
আবিষ্কৃত | ১৭৯৯ |
আবিষ্কার করেছেন | পিয়ের-ফ্রঁসোয়া বুশার |
নির্মিত | ১৯৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে |
বর্তমান অবস্থান | ব্রিটিশ মিউজিয়াম |
ধারণা করা হয় হেলেনিস্টিক সময়কালে খোদাইকৃত এই প্রস্তরফলকটি সম্ভবত মিশরের সাইস শহরের কাছের একটি মন্দিরে সর্বপ্রথম উন্মোচিত হয়। পরবর্তীতে প্রাচীন কোনো সময়ে বা মামলুক সালতানাতের সময় এটি স্থানান্তরিত হয়, এবং অবশেষে নীল বদ্বীপের রাশিদ (পূর্বনাম রোসেটা) শহরে অবস্থিত ফোর্ট জুলিয়েন স্থাপনের সময় এক পর্যায়ে নিমার্ণ-সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলো। ১৭৯৯ সালের জুলাইয়ে মিশরে নেপোলিয়নের সমরাভিযান চলাকালীন সময়ে ফরাসি সৈনিক পিয়ের-ফ্রঁসোয়া বুশার এটি আবিষ্কার করেন। রোসেটা প্রস্তরফলক হচ্ছে আধুনিক সময়ে আবিষ্কৃত হওয়া প্রথম প্রাচীন মিশরীয় দ্বিভাষিক রচনাকর্ম। যেহেতু এই প্রস্তরফলক খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত আধুনিক মানুষের কাছে হায়ারোগ্লিফ লিপি অনুবাদ করা বা অর্থ উদ্ধার করার মতো কোনো সূত্রই ছিলো না, তাই এটি আবিষ্কারের পর তা প্রাচীন মিশরীয় লিপির পাঠোদ্ধারের সম্ভাবনা তৈরি করে, ফলশ্রুতিতে এটির প্রতি ব্যপকভাবে মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ইউরোপীয় জাদুঘরগুলোতে ও পণ্ডিতদের মাঝে এই প্রস্তরফলকের ওপরে খোদাইকৃত শিলালিপির মুদ্রিত অনুলিপি ও ফলকের ছাঁচ ছড়িয়ে পড়ে। ১৮০১ সালে আলেক্সান্দ্রিয়ার আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছে ফরাসিরা আত্মসমর্পণ করলে অন্যান্য নানা প্রত্নতত্ত্বিক নিদর্শনের সাথে প্রস্তরফলকটিও তারা লন্ডনে নিয়ে যায়। ১৮০২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে। রোসেটা প্রস্তরফলক এই জাদুঘরের সর্বাধিক প্রদর্শিত নিদর্শন।
সর্বপ্রথম ১৮০৩ সালে প্রস্তরফলকটিতে থাকা ফরমানের প্রাচীন গ্রিক ভাষায় থাকা অংশটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়। আর এর পরপর-ই বাকি দুই সংস্করণের পাঠোদ্ধারের চেষ্টায় গবেষণা শুরু হয়। ১৮২২ সালে ফরাসি গবেষক জঁ-ফ্রঁসোয়া শাম্পোলিওঁ প্যারিসে বাকি দুইটি মিশরীয় লিপির প্রতিবর্ণীকরণ করার কথা ঘোষণা করেন। তবে নিশ্চিতভাবে ও আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রাচীন মিশরীয় লিপি ও রচনাকর্ম পড়তে গবেষকদের আরও অনেক সময় লেগে যায়। প্রাচীন মিশরীয় লিপির পাঠোদ্ধারে বড় অগ্রগতিসাধনে রোসেটা প্রস্তরফলকের মূল অবদান থাকার পেছনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রস্তরফলকটিতে একই রচনার তিনটি ভিন্ন সংস্করণ ছিলো (১৭৯৯ সালে আবিষ্কৃত), ফলকে থাকা ডেমোটিক লিপির সংস্করণে বিদেশি নামের বানানে ধ্বনিবর্ণমালা ব্যবহার করা হয়েছিলো (১৮০২ সালে আবিষ্কৃত), হায়ারোগ্লিফ লিপিতেও একই কৌশল ব্যবহৃত হয়েছিলো এবং ডেমোটিক লিপির সাথে এর পরিব্যপক সাদৃশ্যতাও ছিলো (১৮১৪ সালে আবিষ্কৃত), এবং স্বদেশি মিশরীয় শব্দগুলোর বানানেও ধ্বনিবর্ণমালা ব্যবহার করা হয়েছিলো (১৮২২–১৮২৪)।
রোসেটা প্রস্তরফলক আবিষ্কারের পরে একই ফরমানের আরও তিনটি টুকরো হয়ে যাওয়া অসম্পূর্ণ অনুলিপি খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষকদের কল্যাণে একই ধরনের আরও কিছু প্রাচীন মিশরীয় দ্বিভাষিক ও ত্রিভাষিক শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে যার মাঝে রোসেটা ফলকের চেয়েও আগে নির্মিত ও জারিকৃত তিনটি টলেমীয় ফরমান রয়েছে। জারিকৃত এসকল ফরমানগুলোর মধ্যে রয়েছে ২৪৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জারিকৃত আলেক্সান্দ্রিয়ার ফরমান, ২৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জারিকৃত ক্যানোপাসের ফরমান, এবং ২১৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চতুর্থ টলেমি কর্তৃক জারিকৃত মেম্ফিসের ফরমান। বর্তমানে রোসেটা প্রস্তরফলক তার অনন্যতা হারালেও প্রাচীন মিশরের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে এটির অবদান অনস্বীকার্য। এ কারণে বর্তমানে জ্ঞানের কোনো শাখায় সমস্যা সমাধানের অপরিহার্য সূত্র খুঁজে পাওয়া গেলে তাকে বর্ণনা করতে অনেক সময় ‘রোসেটা স্টোন’ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়।