মধ্যযুগীয় প্রযুক্তি
From Wikipedia, the free encyclopedia
মধ্যযুগীয় প্রযুক্তি বলতে খ্রিস্টীয় শাসনাধীন মধ্যযুগীয় ইউরোপে ব্যবহৃত প্রযুক্তিকে বোঝায়। দ্বাদশ শতাব্দীর রেনেসাঁর পরে, মধ্যযুগীয় ইউরোপ নতুন উদ্ভাবনের হার, উৎপাদনের ঐতিহ্যগত উপায়গুলি পরিচালনার উপায়ে উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে একটি আমূল পরিবর্তন দেখেছিল।[2] এই সময়কালে বারুদ গ্রহণ, উল্লম্ব বায়ুকল, চশমা, যান্ত্রিক ঘড়ি, উন্নত পানিকল, নির্মান কৌশল (গথিক স্থাপত্য, মধ্যযুগীয় দুর্গ), এবং কৃষিতে (তিন-ক্ষেত্র ফসল আবর্তন) সহ বড় ধরণের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি দেখা যায়।
পানিকলের উন্নয়ন এই অগ্রগতির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। প্রাচীনকাল থেকেই পানিকল ব্যবহার করা হতো, কিন্তু মধ্যযুগে এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে কাঠ ও পাথর কাটার কারখানায় পর্যন্ত, পানিকল বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হত। ইংল্যান্ডে, ডুমসডে বইয়ের সময়কালে, বেশিরভাগ বড় গ্রামেই ঘূর্ণায়মান পানিকল ছিল।[3] খনন কাজেও পানিশক্তি ব্যবহার করা হতো।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে (১২শ থেকে ১৪শ শতাব্দী) প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটে। এই অগ্রগতির মূলে ছিল দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তিগত জ্ঞান, যা রোমান ও বাইজেন্টাইন সভ্যতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। এছাড়াও, ইসলামি বিশ্ব, চীন ও ভারতের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদান-প্রদান এই অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করে। উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হলেও, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগই ছিল মধ্যযুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বারুদের উদ্ভাবন চীনাদের হলেও, ইউরোপীয়রাই এর সামরিক ব্যবহারের সম্ভাবনা পুরোপুরি বিকশিত করে। এর ফলে আধুনিক যুগে ইউরোপের বিস্তার এবং ঔপনিবেশিকতার সূচনা হয়।
মধ্যযুগীয় ইউরোপের (১২শ থেকে ১৪শ শতাব্দী) প্রযুক্তিগত অগ্রগতি কেবল স্থলভাগেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সমুদ্রেও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। জাহাজ নির্মাণ কৌশলের উন্নয়ন, নতুন নৌ-চালনা কৌশল আবিষ্কার এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদান-প্রদান মধ্যযুগীয় ইউরোপকে সমুদ্রের অধিপতি হতে সাহায্য করে। জাহাজ নির্মাণ কৌশলে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়। বহু-পাল বিশিষ্ট জাহাজ, ল্যাটিন পাল, জাহাজের পেছনের দিকে রাডার বসানো এবং কঙ্কাল-ভিত্তিক হাল তৈরির কৌশল জাহাজগুলোকে আরও দ্রুত, স্থিতিশীল এবং দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। নতুন নৌ-চালনা কৌশল আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে শুকনো কম্পাস, জ্যাকবের ছড়ি এবং অ্যাস্ট্রোলেব। এই সরঞ্জামগুলো জাহাজীদের দিক নির্ণয় এবং অবস্থান নির্ধারণে সহায়তা করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদান-প্রদান মধ্যযুগীয় ইউরোপের সামুদ্রিক প্রযুক্তির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসলামি বিশ্ব, চীন এবং ভারতের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাধ্যমে ইউরোপীয়রা নতুন নতুন নৌ-চালনা কৌশল এবং জাহাজ নির্মাণের কৌশল সম্পর্কে জানতে পারে। মধ্যযুগীয় ইউরোপের সামুদ্রিক প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে ইউরোপীয়রা আশেপাশের সমুদ্র এলাকার অর্থনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। পাশাপাশি এই অগ্রগতি অনুসন্ধান যুগের (Age of Exploration) সূচনা করে এবং জলপথে বিশ্ব আবিষ্কারের দিকে পরিচালিত করে।
রেনেসাঁর (১৪শ-১৬শ শতাব্দী) সূচনালগ্নে জ্ঞানের প্রসারে গুটেনবার্গের যান্ত্রিক ছাপাখানার আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান সীমিত সংখ্যক পণ্ডিতের মধ্যে আবদ্ধ থাকার পরিবর্তে ব্যাপক জনগণের কাছে পৌঁছাতে শুরু করে। যান্ত্রিক ছাপাখানার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এটি শিক্ষার ধরন ও প্রসারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। বইমুদ্রণের সহজলভ্যতা জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করে এবং সমাজে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মধ্যযুগের শেষভাগের শিল্পী-প্রকৌশলী গুইডো দা ভিগেভানো এবং ভিলার্ড দি হনেকোর্টের কারিগরি অঙ্কন তাকোলা, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মতো রেনেসাঁর শিল্পী-প্রকৌশলীদের কাজের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়। তাদের কাজে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রয়োগ এবং নকশার নির্ভুলতা রেনেসাঁর যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রেনেসাঁর জ্ঞানের প্রসার কেবল সমাজের কাঠামো পরিবর্তন করে না, বরং ইউরোপীয়দের অন্যান্য সংস্কৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করতেও সাহায্য করে। বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার এবং অভিজ্ঞতার সাহায্যে ইউরোপীয়রা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।