পূর্ব রণাঙ্গন (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ)
From Wikipedia, the free encyclopedia
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব রণাঙ্গন (জার্মান: Ostfront, রুশ: Восточный фронт, Vostochnıy front) ছিল যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল, চূড়ান্ত পর্যায়ে যার বিস্তৃতি ছিল একপ্রান্তে রুশ সাম্রাজ্য ও রোমানিয়ার মধ্যকার সীমান্ত, এবং অন্য প্রান্তে ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য, বুলগেরিয়া, অটোমান সাম্রাজ্য এবং জার্মান সাম্রাজ্য। উত্তরে বাল্টিক সাগর থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত এ রণাঙ্গনের বিস্তৃতি ছিল, যা প্রায় সমগ্র পূর্ব ইউরোপ জুড়ে এমনকি মধ্য ইউরোপ জুড়েও সংঘটিত হয়েছিল। এর সাথে ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গনের তুলনা চলে, যার অবস্থান ছিল বেলজিয়াম ও ফ্রান্স জুড়ে।
পূর্ব রণাঙ্গন | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: ১ম বিশ্বযুদ্ধ | |||||||
উপরে বাঁ দিক থেকে (ঘড়ির কাঁটার দিকে আবর্তিত): কার্পেথিয়ান পর্বতমালায় অবস্থানরত সৈন্যগণ, ১৯১৫; কিয়েভ নগরীতে জার্মান সেনাদের কুচকাওয়াজ, মার্চ, ১৯১৮; রুশ রণতরী "স্লাভা", অক্টোবর, ১৯১৭; রুশ পদাতিক বাহিনী, ১৯১৪; রোমানীয় পদাতিক বাহিনী | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
জার্মান সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি বুলগেরিয়া (১৯১৬-১৭) উসমানীয় সাম্রাজ্য (১৯১৬-১৭) |
রুশ সাম্রাজ্য (১৯১৪–১৭) সোভিয়েত রাশিয়া (১৯১৮) | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
|
নিকোলাই ক্রিলেঙ্কো | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
মোট: ৫৯,০০,০০০ হতাহত |
মোট: ~৯৯,০০,০০০ হতাহত | ||||||
হতাহত বেসামরিক নাগরিক: ২০,০০,০০০+ রাশিয়া: সামরিক কার্যকলাপে ৪,১০,০০০ জনের মৃত্যু যুদ্ধ-সংক্রান্ত কারণে ৭,৩০,০০০ জনের মৃত্যু[14] রোমানিয়া সাম্রাজ্য: সামরিক কার্যকলাপে ১,৩০,০০০ জনের মৃত্যু যুদ্ধ-সংক্রান্ত কারণে ২,০০,০০০ বেসামরিক জনগণের মৃত্যু[15] অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি: সামরিক কার্যকলাপে ১,২০,০০০ বেসামরিক জনগণের মৃত্যু যুদ্ধ-সংক্রান্ত কারণে ৪,৬৭,০০০ বেসামরিক জনগণের মৃত্যু[16] |
পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধের সূচনা হয় রাশিয়ান ফৌজের পূর্ব প্রাশিয়া আক্রমণের সাথে সাথে। একই সঙ্গে রুশ বাহিনী উত্তরে ও দক্ষিণে যথাক্রমে জার্মান সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রাশিয়া এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের গ্যালিসিয়া প্রদেশে দ্বিমুখী আক্রমণ চালায়। উত্তরের আগ্রাসন জার্মানরা প্রতিহত করতে সক্ষম হলেও গ্যালিসিয়ার যুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এর ফলে জার্মানি বাধ্য হয় তার সামরিক শক্তির এক বিরাট অংশ পশ্চিম ইউরোপ থেকে পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধক্ষেত্রে স্থানান্তর করতে। এর ফলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে ধীরে ধীরে এবং ১৯১৫ সাল নাগাদ সম্মিলিত জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান আগ্রাসনের সামনে রাশিয়া, পোল্যান্ড ও গ্যালিসিয়া থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জার নিকোলাস স্বয়ং সেনাবাহিনীর ভার নিজের হাতে তুলে নেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন ঘটে না।
পরবর্তী বছর ১৯১৬ এই যুদ্ধের একটি অন্যতম ঘটনাবহুল সময়। এই বছর রাশিয়া রুশ-তুর্কি ফ্রন্টে বড়সড় সাফল্য অর্জন করে। অন্যদিকে রুশ জেনারেল ব্রুসিলভ পুনরায় গ্যালিসিয়া প্রদেশে সফল অভিযান চালান, যা ইতিহাসে ব্রুসিলভ অফেন্সিভ নামে বিখ্যাত। এছাড়াও নারাচ হ্রদ, বারানাভিচি (বর্তমান বেলারুশ এর অন্তর্গত) ইত্যাদি এলাকায় রাশিয়া কেন্দ্রীয় শক্তির ওপর বিরাট আক্রমণ চালায়। এই অভিযানগুলি সামরিক দিক দিয়ে সফল না হলেও তা পশ্চিম রণাঙ্গনে মিত্রশক্তির ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করে।
১৯১৬ সালের অপর উল্লেখযোগ্য ঘটনা রোমানিয়ার যুদ্ধে যোগদান। এবছর ই আগস্ট মাসে রোমানিয়ার সেনাবাহিনী ট্রানসিলভ্যানিয়া প্রদেশে আক্রমণ চালায়। যদিও রোমানিয়ার সাফল্য ছিল ক্ষণস্থায়ী, কারণ এর পরই দক্ষিণ দিক থেকে বুলগেরিয়ার আক্রমণ এবং জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান প্রতিরোধ তথা পুনরাক্রমণে রোমানিয়া পর্যুদস্ত হয়।
১৯১০ সালে, রুশ সেনাপতি ইউরি দানিলভ তাঁর "পরিকল্পনা ১৯" বাস্তবায়ন করেন, যে পরিকল্পনা অনুযায়ী চারটি রুশ বাহিনী জার্মান সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রুশিয়ায় হামলা চালায়। এ পরিকল্পনাটির সমালোচনা করা হয় কেননা তৎকালীন জার্মান সাম্রাজ্যের তুলনায় অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য অধিক শক্তিশালী ও বিপজ্জনক ছিল। তাই পরিকল্পনা পাল্টে রুশগণ দুটি বাহিনীকে পূর্ব প্রুশিয়ায় ও অপর দুটিকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, যারা তাদের গ্যালিসিয়া রাজ্য থেকে রাশিয়াকে আক্রমণ করতে অগ্রসর হচ্ছিল। যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম কয়েক মাসে রুশ রাজকীয় সেনাবাহিনী পূর্ব প্রুশিয়ায় আক্রমণ ও দখল করার ব্যপক প্রয়াস চালায়, তবে প্রাথমিক কিছু সাফল্যের পর "ট্যানেনবার্গের যুদ্ধে" জার্মান বাহিনী তাদেরকে রুখে দেয়। একই সময়ে দক্ষিণে, রুশ বাহিনী "গ্যালিসিয়ার যুদ্ধে" অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বাহিনীকে পরাজিত করে গ্যালিসিয়ায় অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়। অপরদিকে কংগ্রেস-পোল্যান্ডে জার্মান বাহিনী আক্রমণ চালায়, কিন্তু ওয়ারস' দখল করতে ব্যর্থ হয়। ১৯১৫ সালে জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য একত্রে রুশ সাম্রাজ্যের ওপর হামলা চালায় এবং গ্যালিসিয়া ও পোল্যান্ডে রুশ বাহিনীর ওপর তুমুল আঘাত হানে, এতে রুশ বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয় এবং তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। রুশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক গ্র্যান্ড ডিউক নিকোলাসকে বরখাস্ত করা হয় এবং তাঁর স্থলে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নেন স্বয়ং সম্রাট ("জার")।[17] ১৯১৬ সালে জার্মানদের বিরুদ্ধে রুশ বাহিনী কয়েকটি ব্যর্থ আক্রমণ চালায়, যার মধ্যে অন্যতম "নারোখ হ্রদ আক্রমণ" এবং "বারানোভিচি আক্রমণ"। তবে রুশ জেনারেল আলেক্সেই ব্রুসিলভ অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয়দের বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালান, যা "ব্রুসিলভ অভিযান" নামে পরিচিত, এ আক্রমণ অভিযানে রুশ সেনাবাহিনী বিস্তর ভূখণ্ড দখল করে নেয়।[18][19][20]
১৯১৬ সালের আগস্ট মাসে রুশদের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় রোমানিয়া সাম্রাজ্য। রোমানিয়ার সাহায্যের বিনিময়ে রুশরা তাদেরকে ট্রান্সিলভানিয়া অঞ্চলটি (যা তৎকালীন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল), হস্তান্তর করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। রোমানীয় সেনাবাহিনী ট্রান্সিলভানিয়া আক্রমণ করে এবং প্রাথমিকভাবে সাফল্যের দেখা পায়। তবে জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের মিলিত আক্রমণে ও একই সময়ে দক্ষিণ দিক থেকে বুলগেরিয়ার আক্রমণে শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এসময়ে রাশিয়ায় শুরু হয় বিদ্রোহ (ফেব্রুয়ারি বিপ্লব, ১৯১৭), যার অন্যতম কারণ ছিল যুদ্ধের কারণে জনগণের জীবনে নেমে আসা দুর্ভোগ। জার ২য় নিকোলাস বাধ্য হন সিংহাসন ত্যাগ করতে, এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয় নবগঠিত রুশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার প্রথম নেতা হন জর্জি লেভোভ, শেষ পর্যন্ত তাঁকেও প্রতিস্থাপন করেন আলেক্সান্ডার কেরেনস্কি।
এই নবগঠিত রুশ প্রজাতন্ত্র রোমানিয়া ও তাদের পূর্বের মিত্রদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তবে বলশেভিকগণ কর্তৃক সংগঠিত "অক্টোবর বিপ্লবে" (১৯১৭) রুশ প্রজাতন্ত্রের পতন হয়। কেরেনস্কির নেতৃত্বে রুশ বাহিনী পরিচালনা করেছিল "জুলাই হামলা অভিযান" যা চরমভাবে ব্যর্থ হয় এবং রুশ বাহিনী পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়। রাশিয়ার বলশেভিক দল কর্তৃক নবগঠিত "সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সরকার" কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে শান্তিচুক্তি স্থাপন করে, যা "ব্রেস্ট-লিটভ্স্ক চুক্তি" নামে পরিচিত, এ চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া যুদ্ধ থেকে তাদের সমস্ত বাহিনী প্রত্যাহার করে এবং দখলকৃত বহু অঞ্চলের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেয়। ১৯১৮ সালে রোমানিয়া সাম্রাজ্যও আত্মসমর্পণ করে ও অনুরূপ শান্তিচুক্তিতে সাক্ষর করতে বাধ্য হয়, যা "বুখারেস্ট চুক্তি" হিসেবে জ্ঞাত। তবে, ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় শক্তির পরাজয় ও আত্মসমর্পণে এই দু'টি চুক্তিই অকার্যকর হয়ে যায়।