সোভিয়েত–আফগান যুদ্ধ
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ এ সংঘটিত যুদ্ধ / From Wikipedia, the free encyclopedia
সোভিয়েত–আফগান যুদ্ধ ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আফগানিস্তান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং আফগান মুজাহিদদের মধ্যে সংঘটিত হয়। ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য প্রবেশের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ আরম্ভ হয়, আর ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধে প্রায় ৬ থেকে ২০ লক্ষ আফগান প্রাণ হারায়, যাদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক।
সোভিয়েত–আফগান যুদ্ধ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: স্নায়ুযুদ্ধ, আফগানিস্তান–পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এবং আফগানিস্তান যুদ্ধ (১৯৭৮–বর্তমান) | |||||||
১৯৮৮ সালে আফগানিস্তানে একদল সোভিয়েত স্পেৎসনাজ সৈন্য অভিযানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
আফগানিস্তান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র |
সুন্নি মুজাহিদিন:
শিয়া মুজাহিদিন:
| ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
লিওনিদ ব্রেজনেভ ইউরি আন্দ্রোপভ কনস্তান্তিন চেরনেনকো মিখাইল গর্বাচেভ দিমিত্রি উস্তিনভ সের্গেই সকোলভ দিমিত্রি ইয়াজভ ভ্যালেন্তিন ভ্যারেন্নিকভ ইউরি তুখারিনভ বোরিস ৎকাচ ভিক্তর এর্মাকভ লিওনিদ জেনারেলভ ইগর রোদিয়োনভ ভিক্তর দুবিনিন বোরিস গ্রোমোভ হাফিজুল্লাহ আমিন † বাবরাক কারমাল মুহম্মদ নাজিবুল্লাহ আব্দুল রাশিদ দোস্তাম আব্দুল কাদির শাহনওয়াজ তানাই মোহাম্মেদ রাফি |
বুরহানউদ্দিন রাব্বানী মুহম্মদ আসিফ মুহসিনি আসিফ কান্দাহারি সৈয়দ আলী বেগেশতি মোসবাহ সা'দে | ||||||
শক্তি | |||||||
১,১৫,০০০ সৈন্য ৫৫,০০০ সৈন্য | ২,০০,০০০–২,৫০,০০০ | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
১৪,৪৫৩ সৈন্য নিহত ৫৩,৭৫৩ সৈন্য আহত ২৬৪ সৈন্য নিখোঁজ ১৪৭টি ট্যাঙ্ক ধ্বংসপ্রাপ্ত ১,৩১৪টি আইএফভি/এপিসি ধ্বংসপ্রাপ্ত ৪৩৩টি কামান ও মর্টার ধ্বংসপ্রাপ্ত ১১,৩৬৯টি মালবাহী ও জ্বালানিবাহী ট্রাক ধ্বংসপ্রাপ্ত ১১৮টি যুদ্ধবিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত ৩৩৩টি হেলিকপ্টার ধ্বংসপ্রাপ্ত ১৮,০০০ সৈন্য নিহত |
৭৫,০০০–৯০,০০০ যোদ্ধা নিহত ৭৫,০০০+ যোদ্ধা আহত ৩০০+ সৈন্য নিহত ১টি যুদ্ধবিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত অজ্ঞাতসংখ্যক সৈন্য নিহত ২টি হেলিকপ্টার ধ্বংসপ্রাপ্ত | ||||||
৫,০০,০০০–১৫,০০,০০০ বেসামরিক মানুষ নিহত প্রায় ৩০,০০,০০০ বেসামরিক মানুষ আহত প্রায় ৫০,০০,০০০ বেসামরিক মানুষ আফগানিস্তানের বাইরে উদ্বাস্তু প্রায় ২০,০০,০০০ বেসামরিক মানুষ আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু |
সোভিয়েত সৈন্যদের প্রবেশের আগে ১৯৭৮ সালে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পিডিপিএ আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে এবং নূর মুহম্মদ তারাকী রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। দলটি দেশজুড়ে প্রচলিত ইসলামী মূল্যবোধ ধ্বংস করে কার্ল মার্কস এর কমিউনিজম আগ্রাসনের সূচনা করে, যা ধর্মপ্রাণ গ্রাম্য জনসাধারণ এবং প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার কাঠামোর অধিকারীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ এর জন্ম দেয়। আফগান সরকার কঠোরভাবে বিরোধিতা দমন করে, হাজার হাজার লোককে গ্রেপ্তার করে এবং প্রায় ২৭,০০০ রাজনৈতিক বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেকগুলো সরকারবিরোধী সশস্ত্র দল গঠিত হয় এবং ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে আফগানিস্তানের বড় একটি অংশ জুড়ে বিদ্রোহ দেখা দেয়। তদুপরি, আফগান সরকার অন্তদ্বন্দ্বের কারণে অস্থিতিশীল ছিল এবং ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে হাফিজুল্লাহ আমিনের সমর্থকেরা তারাকীকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমিনকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করে। আফগান কমিউনিস্ট শাসকদের দ্বারা কমিউনিজম এর স্বার্থ পুরোপরিভাবে উদ্ধার না হওয়ায় এবং আফগানিস্তানে ব্যাপক বিদ্রোহের কারণে লিওনিদ ব্রেজনেভের নেতৃত্বে সোভিয়েত সরকার ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সোভিয়েত ৪০তম আর্মি মোতায়েন করে। এর মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ আগ্রাসনের সূচনা হয়। রাজধানী কাবুলে পৌঁছানোর পর সোভিয়েত সৈন্যরা একটি অভ্যুত্থানের নাটক করে রাষ্ট্রপতি আমিনকে হত্যা করে এবং একটি প্রতিদ্বন্দ্বী উপদলের সদস্য সোভিয়েতপন্থী বাবরাক কারমালকে ক্ষমতায় বসায়।
১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে ৩৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ আফগানিস্তান থেকে "সোভিয়েত সৈন্যদের তাৎক্ষণিক, জরুরি এবং নি:শর্ত প্রত্যাহারের" দাবি জানিয়ে প্রস্তাব পেশ করে, অন্যদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪–১৮ ভোটে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রস্তাব গৃহীত হয়। আফগান বিদ্রোহীরা প্রতিবেশী পাকিস্তান ও চীনে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পারস্য উপসাগরীয় আরব রাজ্যগুলো থেকে বিপুল আর্থিক সহায়তা প্রাপ্ত হয়।
সোভিয়েত সৈন্যরা আফগানিস্তানের শহর ও যোগাযোগ কেন্দ্রগুলো দখল করে, অন্যদিকে মুজাহিদিনরা আফগানিস্তানের যে ৮০ শতাংশ ভূমি আফগান সরকার ও সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল সেসব অংশে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করে। সোভিয়েতরা আফগান বিদ্রোহী ও বেসামরিক জনগণকে কঠোরভাবে মোকাবেলা করার জন্য বিমানশক্তি ব্যবহার করে, মুজাহিদিনদের নিরাপদ আশ্রয় লাভের সুযোগ না দেয়ার উদ্দেশ্য গ্রামের পর গ্রাম মাটিতে মিশিয়ে দেয়, সেচ খালগুলো ধ্বংস করে এবং লক্ষ লক্ষ ভূমি মাইন ছড়িয়ে দেয়।
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যসংখ্যা ১,০৮,০০০-এ বর্ধিত করা হয় এবং দেশব্যাপী সংঘর্ষ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপুল সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝিতে সংস্কারপন্থী নেতা মিখাইল গর্বাচেভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সরকার আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। ১৯৮৮ সালের ১৫ মে আফগানিস্তান থেকে চূড়ান্তভাবে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার আরম্ভ হয় এবং ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়। এই যুদ্ধের দীর্ঘ ব্যাপ্তির জন্য এটিকে কখনো কখনো পশ্চিমা গণমাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা ভল্লুকের ফাঁদ হিসেবে অভিহিত করা হয়, এবং যুদ্ধটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।